রাজধানী ঢাকা এখন আন্দোলনের নগরী। যেন দাবি-দাওয়া আদায়ের মৌসুম চলছে, দাবি আদায়ের পালে হাওয়া লেগেছে।
প্রতিদিনই নিত্যনতুন দাবিতে রাজপথের আন্দোলন দানা বাধছে। সড়ক ও রেল অবরোধের পাশাপাশি প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনও ঘেরাও হচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, গত ছয় মাসে ১৭০টির মতো আন্দোলন হয়েছে। আন্দোলনের কারণে জনজীবন চরম দুর্ভোগে পড়ছে।
তবুও পতিত সরকারের মতো দমনপীড়ন নীতির পরিবর্তে নমনীয় অবস্থানে দেখা যাচ্ছে সরকারকে। এক-দুইদিন নয়, গত ছয় মাস ধরে দিনের পর দিন প্রায় একই ধরনের পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
এমতাবস্থায় পতিত আওয়ামী লীগও আবার কর্মসূচি দিয়েছে, রাজনৈতিক আন্দোলন শুরুর আভাস দিয়েছে বিএনপিও। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টানা সাড়ে ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের আন্দোলনের সুযোগ সীমিত থাকায় এখন দাবি-দাওয়া আদায়ের হিড়িক পড়েছে, যা অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করছে। গত ছয় মাসে অনেকের দাবি পূরণ হলেও প্রতিনিয়ত পুরোনো ও নতুন অনেক পক্ষ আগের এবং নতুন নতুন দাবি নিয়ে রাস্তায় নামছে। গতকাল শুক্রবার ছুটির দিনেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ড. ইউনূসের বাসভবন ঘেরাও কর্মসূচি পালন করেছেন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কোটা বিলোপের আন্দোলন পর্যায়ক্রমে টানা সাড়ে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকায় শেখ হাসিনা সরকারের পতনের আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতা ছেড়ে পালিয়ে ভারতে চলে যান শেখ হাসিনা। ক্ষমতাচ্যুত সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা চলে যান আত্মগোপনে। জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় সরাসরি যুক্ত থাকা এবং আন্দোলনকারীদের হামলার মুখে ভেঙে পড়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি। পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে মাঠে দেখা যায়নি, তবে সক্রিয় ছিল সেনাবাহিনী। এমন পরিস্থিতিতে তিনদিন পর ৮ আগস্ট নোবেলজীয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম দৈনিক টার্গেটকে বলেন, বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের সৃষ্ট সব বোঝা অন্তর্বর্তী সরকারকে নিতে হয়েছে। দুর্বল অর্থনৈতিক অবস্থা, ভঙ্গুর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি, একনায়কতন্ত্রয় জবাবদিহিতার অনুপস্থিতি, আইনের শাসন না থাকাসহ আরো কত কী…! ময়লা-আবর্জনার স্তূপ রেখে গেছে আওয়ামী লীগ, সেগুলোকে সরিয়ে দেশটাকে এগিয়ে নেওয়াই হচ্ছে এ সরকারের কাজ, সে কাজই করা হচ্ছে।
একাধিক সূত্রমতে, নতুন সরকারের জন্য প্রথম চ্যালেঞ্জ হিসেবে আবির্ভূত হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে মাঠে নামানো এবং অরাজক পরিস্থিতি উত্তরণ। পুলিশকে সময় বেধে দিয়ে চাকরিতে যোগদানের নির্দেশ দেওয়া হলেও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে কয়েক মাস লেগে যায়। এর মধ্যেই পুলিশের একটি অংশ বিভিন্ন দাবি সামনে রেখে আন্দোলনে নামে, যা ‘পুলিশ লীগ’; আনসারদের আন্দোলন রক্তক্ষয়ী হয়ে, যা ‘আনসার লীগ’; ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের আলটিমেটাম দেওয়া আন্দোলন ‘হিন্দু লীগ’; ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকদের আন্দোলনও ‘অটোরিকশা লীগ’; সাবেক ও বর্তমান আমলাদের আন্দোলন ‘আমলা লীগ’; গার্মেন্টস শ্রমিকদের আন্দোলন ‘গার্মেন্টস লীগ’ হিসেবে আখ্যা পায়। বড় এসব আন্দোলনের পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব নিয়ে আন্দোলন, শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের আন্দোলন, স্কুল-কলেজ ও মাদরাসার শিক্ষকদের আন্দোলনসহ নানা দাবিতে বিভিন্ন গ্রুপ, পক্ষ ও সংগঠন একের পর এক কর্মসূচি পালন করে। এ ছাড়া রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতি থেকে শুরু করে তাবলিগ-জামাতের মতো ধর্মীয় সংগঠনকে দুই গ্রুপে ভাগ করে দেওয়াকে কেন্দ্র করে আন্দোলনসহ পেশাজীবী, সরকারি-বেসরকারি অনেকে আন্দোলন করে, যা সামাল দিতে হয় অন্তর্বর্তী সরকারকে।
এসব আন্দোলন প্রধানত রাজপথে হওয়ায় সড়ক অবরোধ, সচিবালয় ঘেরাও, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন ঘেরাওয়ের মতো কর্মসূচিও ছিল। কখনো কখনো একই দিনে রাজধানীর অন্তত ২০-৩০ স্থানেও আন্দোলনের ঘটনা ঘটে। এতে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়, নগরবাসী পড়েন সীমাহীন ভোগান্তিতে। এসব ঘটনা অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে, মনোযোগ দিতে হয় বিভিন্ন দাবি পূরণ ও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার প্রতি। কিন্তু এক্ষেত্রে শেখ হাসিনার দীর্ঘ শাসনের কারণে চার স্তরে আমলাদের সাজানোর কারণে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় ধীরগতিতে এগোতে হয় অন্তর্বর্তী সরকারকে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দৈনিক টার্গেটকে বলেন, দীর্ঘদিনের পুঞ্জীভূত দাবি-দাওয়া কর্তৃত্ববাদী (আওয়ামী লীগ) সরকার শুধু অবজ্ঞাই করেনি, দাবি-দাওয়া উত্থাপন করেছে যৌক্তিক হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে বিদ্রুপ করা, প্রতিরোধ করা কিংবা অধিকার হরণ করা হয়েছে। বাক্স্বাধীনতাহরণসহ মৌলিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। অনেক যৌক্তিক দাবিগুলোও পাশ কাটিয়ে অবজ্ঞা করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসে ছোট-বড় কতগুলো আন্দোলন হয়েছে, এর মধ্যে কতগুলো ন্যায্য ও যৌক্তিক আর কতগুলো ষড়যন্ত্রমূলক। এ সময়ে ১৭০টি আন্দোলন হছে বলে বৃহস্পতিবার ভার্চুয়ালি একটি টকশোতে যুক্ত হয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব উল্লেখ করেছেন।
প্রধান উপদেষ্টার সিনিয়র সহকারী প্রেস সচিব ফয়েজ আহম্মদ দৈনিক টার্গেটকে বলেন, বিগত ১৬ বছর ধরে যে সরকার মানুষের ঘারে চেপে ছিল, সেই সরকার কখনও কোনও পর্যায়ে মানুষের ন্যায্য দাবিকেও বুঝতে চায়নি। মানুষ তার দাবিদাওয়া নিয়ে কখনোই কোনো পরিসরেই রাজপথে নেমে আসতে পারেনি, কথা বলতে পারেনি। এসব মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ, মানুষের চাওয়া, দাবি-দাওয়া সবকিছু এখন একত্রিত হয়েছে। এখন মানুষ তার ন্যায্য দাবি নিয়ে রাস্তায় নামছে, তারা মনে করছে এখনই সময়। একটা উপযুক্ত পরিবেশ পেয়েছে তারা, সেজন্য দাবিগুলো করছে। যেসব দাবি উঠছে, যত আন্দোলন হচ্ছে, তাসব অন্যায্য নয় এর মধ্যে ন্যায্যও রয়েছে।
তিনি বলেন, প্রশাসনসহ বিভিন্ন স্তরে বিগত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা করা অপশাসনকেও এখন একটা নিয়মের মধ্যে আনা হচ্ছে। এটা তাদের সৃষ্টি করে যাওয়া দীর্ঘদিনের এক ধরনের বোঝা, সেগুলো অন্তর্বর্তী সরকার যতটুকু দক্ষতা আছে তা দিয়ে ক্লিন আপ করার চেষ্টা করছে। এই প্রচেষ্টা চলমান থাকবে। অন্তর্বর্তী সরকারের গত ৬ মাসের বিভিন্ন সময় নানা দাবি সামনে রেখে ষড়যন্ত্রমূলক আন্দোলন হয়েছে। নামকাওয়াস্তে দাবি নিয়ে নানান সময় নানান বাহিনী রাস্তায় নেমে আসছে ভিন্ন ভিন্ন নামে। এর মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল, দেশের মানুষের শান্তি বিনষ্ট করার অপচেষ্টা করা হয়েছে এবং হচ্ছে।
সূত্রমতে, পুলিশ-আমলা থেকে শুরু করে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও বাহিনীর সিংহভাগ বিগত সরকারের সময় ‘ফ্যাসিবাদী শাসনের’ সহযোগী হওয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার চিহ্নিতদের কাউকে গ্রেপ্তার, কাউকে অবসরে পাঠানো, কাউকে বদলিসহ নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকার টায়ারে টায়ারে দলীয়, অনুগত ও সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের বসানোয় বদলির পর বদলি করতে হচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকারকে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে বিভাগ, জেলা ও উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত গত সাড়ে ১৫ বছরে বিছানো মাকড়সার জাল পুরোপুরি ছিন্ন করা সম্ভব না হলেও মোটা দাগে উল্লেখযোগ্য ও গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় করা হয়েছে।
অবশ্য বিএনপিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলো অভিযোগ করে আসছে, সচিবালয় থেকে নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও পদে ‘ফ্যাসিবাদের চিহ্নিত প্রেতাত্মা ও দোসররা’ এখনো বহাল তবিয়তে রয়েছে। গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটি বলছে, ‘ফ্যাসিবাদের চিহ্নিত দোসররা’ এখনো সক্রিয়। তারা সরকারকে ব্যর্থ করতে অপচেষ্টা করছে। কেবল বদলি নয়, তাদের বের করে দিতে হবে, তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।
আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরের শাসনামলে যৌক্তিক ও ন্যায়সংগত দাবিও বছরের পর বছর উপেক্ষা করেছে। প্রতি অর্থবছর এবং সরকারের শেষের আগে দাবি-দাওয়া আদায়ের মৌসুম ছিল। কিন্তু বিগত সরকার টানা ক্ষমতায় থাকায় ছিল এর উল্টো চিত্র। সেভাবে দাবি-দাওয়া উপস্থাপন করতে দেওয়া হয়নি, আবার যেসব দাবি উপস্থাপিত হতো, তা-ও পূরণ না করে চাপ দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের একপেশে বিভিন্ন সিদ্ধান্তে নানা ইস্যু সৃষ্টি হয়েছে, তাতেও নতুন করে দাবি-দাওয়া সামনে এসেছে। আর প্রতিটা জাতীয় নির্বাচনের আগে পুলিশ, প্রশাসনের কর্মকর্তা ও সরকারি চাকরিজীবীদের বাড়তি সুযোগ-সুবিধা দেয় আওয়ামী লীগ সরকার, সীমাহীন দলীয়করণ করে। তাতে কর্মজীবীদের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। চাকরিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে সব নিয়মনীতি উপেক্ষা করে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগের কারণে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র এ সোনার হরিণের দেখা পেতেন। বাকিদের বিভিন্ন ধাপে নানাভাবে আটকে দেওয়া হতো চাকরিপ্রাপ্তি।
ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট কর্তৃত্ববাদের পতনের পর নতুন বাংলাদেশে অধিকারহরণের পাশাপাশি পুঞ্জীভূত দাবি পূরণের প্রত্যাশা করছেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশ নেওয়া বা সমর্থন দেওয়া সবাই।
এই দাবি-দাওয়া আদায়ের মাধ্যমগুলোর মধ্যে অনেক ক্ষেত্রে একটা চাপিয়ে দেওয়ার প্রবণা লক্ষ করা যাচ্ছে। হয়তো অনেকেই ভাবছেন, এখনই সুযোগ দাবি আদায়ের। অন্য সরকার ক্ষমতায় এলে এ সুযোগ পাওয়া যাবে কি না এ ধরনের উদ্বেগ থাকতে পারে।
তবে অনেক সময় সরকারের ওপর প্রত্যাশার চেয়ে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি হচ্ছে আর অনেক ক্ষেত্রে সরকারের সক্ষমতারও বাইরে অনেক দাবি-দাওয়া। আন্দোলন করা সবার অধিকার। অনেক সময় যেভাবে তা করা হচ্ছে, তাতে জনজীবনও বিপর্যস্ত হচ্ছে। দাবি আদায়ের পদ্ধতিটা গণতান্ত্রিক চর্চায় হওয়া দরকার। অন্যথায় নতুন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণ এবং সুশাসনের স্বপ্ন ও প্রত্যাশা আরো বেশি ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে।