জুলাই বিপ্লবের চার গানম্যান

  • দৈনিক টার্গেট
  • প্রকাশ: ০১:৪৫:২০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪
  • ১২৭ বার পঠিত হয়েছে

তারুণ্য ছিল জুলাই বিপ্লবের প্রধান শক্তি। তারুণ্যে ক্ষুধা নিবারণের অন্যতম অনুষঙ্গ গান। আর তাই জুলাই বিপ্লব চলাকালে কয়েকটি গান ঘুরে বেড়িয়েছে বিপ্লবীদের মুখে, শহরের দেয়ালে ও সামাজিক মাধ্যমে। র‌্যাপার হান্নান ও সেজানের হিপহপ গান যেমন ছাত্র-জনতার রক্তে আগুন জ্বেলে দিয়েছে, তেমনি আলতাফ কিংবা পারশার গানের গভীরতা জনতার ভাবনাকে জাগ্রত করেছে, সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে।

এ ছাড়াও, অনেকে যখন স্বৈরাচারী সরকারের সমালোচনা করে দেওয়া ফেসবুক পোস্টে লাইক দিতে ভয় পাচ্ছিলেন, তখন হাতে গোনা দু-চারজন শিল্পী গানের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। মাঠের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে তাদের গানের ভূমিকাও অনস্বীকার্য।

দীর্ঘ সংগ্রামের শেষ পেরেক আসিফ আলতাফের স্টেপডাউন

সংগীতশিল্পী আসিফ আলতাফ দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদী গান গেয়ে আসছেন। তার লেখা ও গাওয়া গান স্বৈরাচারের চক্ষুশূল হয়েছে। যার ফলে ভোলায় আসিফ আলতাফের বাড়িতে হামলা করা হয়েছে, একাধিক মামলার ঘানি টানতে হয়েছে শিল্পী ও তার পরিবারকে। ‘ফ্যাসিবাদী পাগলা ঘোড়া’, ‘স্বাধীনতা’, ‘বেচিনি মাথা’, ‘ওপারেতে বসে’, ‘লেবাস’সহ বেশ কিছু গানে সরাসরি স্বৈরাচারের অপশাসন তুলে ধরেছেন আসিফ আলতাফ।

জুলাই আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন নিজের লেখা ও সুরে তৈরি করেন ‘স্টেপডাউন’ শিরোনামের একটি গান। এতে তুলে ধরেন ছাত্র আন্দোলন ও তৎকালীন সরকার এবং প্রশাসনের স্বৈরাচারী আচরণ।

গানটি নিয়ে আসিফ আলতাফ বলেন, ‘রক্তে আগুন জ্বালার মতো একটা গান তৈরি করার পর কত দ্রুত জনমানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারব, সেই তাড়না থাকে আমার। স্টেপডাউন গানটা ৩ আগস্ট থেকে আপলোড দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আপলোড হচ্ছিল না। কয়েকবার আপলোড হলেও পাঁচ মিনিটের মধ্যে ইউটিউব থেকে গানটি নামিয়ে ফেলা হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমিও রিআপলোড দিতে থাকি। প্রতিবারই ফেল করে একবার ভেবেছিলাম গানটা বুঝি জনতার কাছে পৌঁছাবে না। তখন নেটওয়ার্কও বন্ধ ছিল। ৫ আগস্ট নেটওয়ার্ক পেয়ে আবার সকাল থেকে চেষ্টা করতে থাকি। বেলা ১১টায় গান আপলোড হয়। এরপরই তো স্বৈরাচারের পালিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে যাই।’

এই গানের কমেন্ট সেকশনে এমএস জাহান নামে একজন লেখেন, ‘আসিফের প্রতিবাদী গানগুলো ১০-১৫ বছর ধরে আমাদের সান্ত্বনা দিয়েছে, আজ তার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছে পুরো দেশের মানুষ! আসিফ তোমার প্রতিবাদী কণ্ঠ চিরকাল অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক, কখনো কারও দাসত্বের সুরে যেন সুর না মেলায় এই দোয়া।’

মতিন মাহমুদ নামে একজন কমেন্টে লেখেন, ‘আমার ভোটটা আমি কুকুরকে দেব তবু তোমার ব্যালটে ভোট দেব না’- এত সাহসী ও শক্তিশালী লেখা গানে তুলে আনার জন্য আসিফ আলতাফকে স্যালুট। এই সময়ে এমন একটা গানই আমাদের দরকার ছিল’।

গান প্রকাশের বিড়ম্বনা জানতে চাইলে আসিফ আলতাফ বলেন, ‘আমার ভাষা মিছিল আর গান। আমি এই দুই মাধ্যমকে মিলিয়ে গান গাই। যখন রাজপথে গলা ছেড়ে মিছিল করতে না পারি, তখন প্রতিবাদের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে গান। পুরো স্বৈরাচারের শাসনকাল আমি রাজপথ ও গানের মাধ্যমে প্রতিবাদ করে কাটিয়েছি। আমার ও আমার পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক মামলা দেওয়া হয়েছে। তাতেও দমে যাইনি।’

জুলাই বিপ্লব সফল হলে ভারতের নদী আগ্রাসনের শিকার হয় ফেনী নোয়াখালীর মানুষ। আলতাফ এই ঘটনার প্রতিবাদ জানান ‘দালালের বন্যা’ নামের একটি গানে। গানটি রাতারাতি ছড়িয়ে যায় সামাজিক মাধ্যমে। কয়েক কোটি দর্শক দেখে গানটি।

রক্তে আগুন জ্বালায় সেজানের ‘কথা ক’

র‌্যাপার সেজানের ‘কথা ক’ শিরোনামের হিপহপ গানটি মুক্তি পায় ১৬ জুলাই। মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে দাবানলের মতো ছড়িয়ে যায়। গানের কথাগুলো মিছিলের মতো প্রতিবাদী। ‘জোর যার মুল্লুক তার/ আগে ক মুল্লুক কার/ লাঠির জোরে কলম ভাঙে শান্তির নামে তুলল খার কাইল মারলি, পরশু মারলি/মারতে আইলি আজ আবার! রাজায় যহন প্রজার জান লয় জিগা তাইলে রাজা কার?’ এমন কথা হয়ে ওঠে কোটি জনতার কথা।

গানটি নিয়ে র‌্যাপার সেজান বলেন, ‘১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ছাত্রদের মারা হচ্ছিল। সেই রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হয়ে উঠেছিল। খবরটা শুনে খুব খারাপ লেগেছিল, সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। পরদিন চিন্তা করলাম, কিছু একটা করতে হবে। আমি গানটা পারি। ১৬ জুলাই দুপুরের মধ্যে লিখে ফেললাম ‘কথা ক’। ঘোরের মধ্যে রেকর্ড শেষ করলাম; সেদিন সন্ধ্যা নাগাদ গানটা প্রকাশ করি।

তিনি বলেন, ‘গানটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। যারা আমার গান আগে কখনোই শোনেনি, তাদের কাছেও গানটা পৌঁছেছে। এর কারণ হয়তো সাধারণ মানুষ গানটাতে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে; গানের কথাগুলোকে প্রাসঙ্গিক মনে করেছে।’

গান প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিপদ আসতে থাকে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গানে আমি গণমানুষের কথা বলছি, আমাদের ট্যাক্সের টাকায় গুলি আমাদের ওপর চালাবে কেন? তারাও ছাত্র, ছাত্ররা ছাত্রদের ওপর কেন আক্রমণ করে? এই ব্যাপারগুলো কাউকে না কাউকে বলতে হতোই। আমার মনে হয়েছে, ফলে আমিই বলেছি। ওই সময় দেশের অবস্থা খারাপ ছিল। ছোট ভাইবোনেরা মার খাচ্ছে। ওই সময় চিন্তা করেছিলাম, মানুষ হয়তো গানটা শোনার মানসিকতায় নেই। কিন্তু এ গান এত মানুষ শুনেছে, যা অবাক হওয়ার মতো।’

গান ও আন্দোলনের কারণে এলাকাছাড়া হওয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে সেজান বলেন, ‘১৬ জুলাই গান প্রকাশের পরদিন ১৭ জুলাই নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলাম। আন্দোলনে যাওয়ার পরপরই ছবিগুলো ছড়িয়ে যায়। এগুলো নিয়ে অনেক চাপ আসতে থাকে। পুলিশ ও ডিবি খোঁজা শুরু করে। একটা পর্যায়ে এলাকাছাড়া হতে হয়েছিল।’

দীর্ঘদিন ধরে র‌্যাপ গান করেন সেজান। গান আপলোড করেন নিজের ইউটিউব চ্যানেলে। তার চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ।

গানের কারণে গুম জেল রিমান্ড

‘আওয়াজ উডা বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি হিপহপ র‌্যাপ গান করেন হান্নান। গানটি ইউটিউবে মুক্তি দেন ১৮ জুলাই। ‘গদিত বইসে স্বৈরাচার কত কিছু সইয়া আর/ তর পজিশন টিক্কা থাকব কত ভাই ক মইরা আর?’ এমন কথা গানটিকে দ্রুত ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে। আন্দোলনের ভিডিওর সঙ্গে গানটা জুড়ে দিয়ে অনেকে ভিডিও আপলোড করেন সামাজিক মাধ্যমে।

গানে কথা, সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন র‍্যাপার হান্নান হোসাইন শিমুল এবং মিক্স ও মাস্টারিং করেছে স্নেয়ারবিট।

হান্নান জানান, গানটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে ২৫ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ভুইঘর এলাকা থেকে তাকে আটক করে ফতুল্লা থানা পুলিশ। যদিও গণমাধ্যমে সে কথা স্বীকার করেননি ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। পরে তার জন্য রিমান্ডের আবেদন করলে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। ১৩ দিন জেল খেটে যখন মুক্তি পান, তত দিনে স্বৈরাচার পালিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমি যখন আটক হয়েছি, তখন থেকে ৩৬ ঘণ্টা আমার পরিবার জানতে পারেনি যে, আমি আটক।’

সে সময়কার ঘটনা মনে করে হান্নান বলেন, ‘কী হচ্ছে, কোনো মামলা দিচ্ছে কি না, কেমনে কোথায় নেবে, বুঝতে পারছিলাম না। দেড় দিন পর যখন কারাগারে দিয়ে আসে, তখন বুঝতে পারলাম, এখানে কিছুদিন থাকতে হবে। দিনগুলো খুব কষ্টকর হবে।’

বন্দি অবস্থার দিনগুলোর কথা স্মরণ করে হান্নান বলেন, ‘আমাকে একটু বেশি অত্যাচার করা হয়েছে। কারাগারের সাধারণ কয়েদিদের মতো আমাকে রাখা হয়নি। আমাকে একটা টাওয়ারে রাখা হয়েছিল, যেখান থেকে বের হওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সাধারণ বন্দিরা তো ৭টা থেকে ৫টা পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতে পারত। আমাকে ছোট একটা সেলে রাখা হয়েছিল। আমার সঙ্গে আরও দুজন ছিলেন। আমি বের হতে পারতাম না, শুধু তিন বেলা খেতে পারতাম।’

নতুন বাংলাদেশ পেয়ে প্রচণ্ড খুশি হান্নান। নিজের নতুন গান নিয়ে আপাতত ব্যস্ত সময় পার করছেন। সম্প্রতি স্পিরিট অব জুলাইয়ের আয়োজনে ‘ইকোস অব রেভোলিউশন কনসার্ট’-এ গান গেয়েছেন হান্নান। গান দিয়ে তার প্রতিবাদ ও স্বপ্নের কথা বলতে চান এ শিল্পী।

দেশের পরিস্থিতি ফুটে ওঠে পারশার এক গানে

নিজের লেখা, সুর করা ও গাওয়া ‘চলো ভুলে যাই’ শিরোনামে একটি গান ২৮ জুলাই সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন পারশা মাহজাবীন। ‘চলো দেখে নিই বাতাবিলেবু লটকনে দেশ ছাড়িয়ে চলো কেঁদে ফেলি ফ্লাইওভার আর মেট্রোরেলটা জড়িয়ে’ এমন জ্বালাময়ী কথা ফুটে ওঠে পারশা মাহজাবীনের গানে। এই গানটিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে।

গানটি নিয়ে পারশা বলেন, ‘মাত্র ১০ মিনিটে বসে গানটি লিখে ফেলি। তখন মাথায় আর কিছু ছিল না। কেবল গানের কথাগুলো ঘুরছিল। গানটা দেশের মানুষ যেমন ভালোবেসে গ্রহণ করেন, তেমনি কমেন্টে হুমকি দিতে থাকেন অনেকে। ভাগ্য ভালো আমার নাম্বার খুব বেশি মানুষের কাছে ছিল না। আমার ঠিকানাও জানত না। ফলে অনলাইন ছাড়া খুব বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘আমি চাই আমার দেশ মা, আমার বাংলা মা আবার সুস্থ হয়ে ফিরুক। যে দেশের মাটিতে বসে আমি শব্দচয়ন শিখেছি, গাইতে শিখেছি, এভাবে লিখতে শিখেছি সেই দেশ ভালো থাকুক। আমি চাই, আমার দেশের মানুষ ভালো থাকুক, আর কোনো মায়ের কোল খালি না হোক। আমি চাই সব সহিংসতার বিচার হোক, আমার ভাইবোনদের রক্তের দাম দেওয়া হোক। সেই ভাবনাই গানে ফুটিয়ে তুলেছি।’

নতুন গান লেখার পাশাপাশি পারশা ব্যস্ত অভিনয়ে। সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকির একটি ওয়েব ফিল্মে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। জাহিদ প্রিতম পরিচালিত ওয়েব ফিল্মটির নাম ‘ঘুমপরী’। ঘুমপরী দিয়ে প্রথমবারের মতো কোনো ওয়েব ফিল্মে অভিনয় করছেন এই গায়িকা ও অভিনেত্রী। ফলে কাজটা নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত পারশা মাহজাবীন।

শেখ হাসিনার উস্কানিমূলক বক্তব্যে বিক্ষিপ্ত ছাত্র-জনতার তোপে নিরাপত্তায় বঙ্গভবন

জুলাই বিপ্লবের চার গানম্যান

প্রকাশ: ০১:৪৫:২০ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

তারুণ্য ছিল জুলাই বিপ্লবের প্রধান শক্তি। তারুণ্যে ক্ষুধা নিবারণের অন্যতম অনুষঙ্গ গান। আর তাই জুলাই বিপ্লব চলাকালে কয়েকটি গান ঘুরে বেড়িয়েছে বিপ্লবীদের মুখে, শহরের দেয়ালে ও সামাজিক মাধ্যমে। র‌্যাপার হান্নান ও সেজানের হিপহপ গান যেমন ছাত্র-জনতার রক্তে আগুন জ্বেলে দিয়েছে, তেমনি আলতাফ কিংবা পারশার গানের গভীরতা জনতার ভাবনাকে জাগ্রত করেছে, সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে উদ্বুদ্ধ করেছে।

এ ছাড়াও, অনেকে যখন স্বৈরাচারী সরকারের সমালোচনা করে দেওয়া ফেসবুক পোস্টে লাইক দিতে ভয় পাচ্ছিলেন, তখন হাতে গোনা দু-চারজন শিল্পী গানের মধ্য দিয়ে প্রতিবাদ করেছেন। মাঠের আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে তাদের গানের ভূমিকাও অনস্বীকার্য।

দীর্ঘ সংগ্রামের শেষ পেরেক আসিফ আলতাফের স্টেপডাউন

সংগীতশিল্পী আসিফ আলতাফ দীর্ঘদিন ধরে প্রতিবাদী গান গেয়ে আসছেন। তার লেখা ও গাওয়া গান স্বৈরাচারের চক্ষুশূল হয়েছে। যার ফলে ভোলায় আসিফ আলতাফের বাড়িতে হামলা করা হয়েছে, একাধিক মামলার ঘানি টানতে হয়েছে শিল্পী ও তার পরিবারকে। ‘ফ্যাসিবাদী পাগলা ঘোড়া’, ‘স্বাধীনতা’, ‘বেচিনি মাথা’, ‘ওপারেতে বসে’, ‘লেবাস’সহ বেশ কিছু গানে সরাসরি স্বৈরাচারের অপশাসন তুলে ধরেছেন আসিফ আলতাফ।

জুলাই আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন নিজের লেখা ও সুরে তৈরি করেন ‘স্টেপডাউন’ শিরোনামের একটি গান। এতে তুলে ধরেন ছাত্র আন্দোলন ও তৎকালীন সরকার এবং প্রশাসনের স্বৈরাচারী আচরণ।

গানটি নিয়ে আসিফ আলতাফ বলেন, ‘রক্তে আগুন জ্বালার মতো একটা গান তৈরি করার পর কত দ্রুত জনমানুষের সামনে উপস্থাপন করতে পারব, সেই তাড়না থাকে আমার। স্টেপডাউন গানটা ৩ আগস্ট থেকে আপলোড দেওয়ার চেষ্টা করেছি, কিন্তু আপলোড হচ্ছিল না। কয়েকবার আপলোড হলেও পাঁচ মিনিটের মধ্যে ইউটিউব থেকে গানটি নামিয়ে ফেলা হয়।’

তিনি বলেন, ‘আমিও রিআপলোড দিতে থাকি। প্রতিবারই ফেল করে একবার ভেবেছিলাম গানটা বুঝি জনতার কাছে পৌঁছাবে না। তখন নেটওয়ার্কও বন্ধ ছিল। ৫ আগস্ট নেটওয়ার্ক পেয়ে আবার সকাল থেকে চেষ্টা করতে থাকি। বেলা ১১টায় গান আপলোড হয়। এরপরই তো স্বৈরাচারের পালিয়ে যাওয়ার খবর পেয়ে যাই।’

এই গানের কমেন্ট সেকশনে এমএস জাহান নামে একজন লেখেন, ‘আসিফের প্রতিবাদী গানগুলো ১০-১৫ বছর ধরে আমাদের সান্ত্বনা দিয়েছে, আজ তার কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছে পুরো দেশের মানুষ! আসিফ তোমার প্রতিবাদী কণ্ঠ চিরকাল অন্যায়ের প্রতিবাদ করুক, কখনো কারও দাসত্বের সুরে যেন সুর না মেলায় এই দোয়া।’

মতিন মাহমুদ নামে একজন কমেন্টে লেখেন, ‘আমার ভোটটা আমি কুকুরকে দেব তবু তোমার ব্যালটে ভোট দেব না’- এত সাহসী ও শক্তিশালী লেখা গানে তুলে আনার জন্য আসিফ আলতাফকে স্যালুট। এই সময়ে এমন একটা গানই আমাদের দরকার ছিল’।

গান প্রকাশের বিড়ম্বনা জানতে চাইলে আসিফ আলতাফ বলেন, ‘আমার ভাষা মিছিল আর গান। আমি এই দুই মাধ্যমকে মিলিয়ে গান গাই। যখন রাজপথে গলা ছেড়ে মিছিল করতে না পারি, তখন প্রতিবাদের প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে গান। পুরো স্বৈরাচারের শাসনকাল আমি রাজপথ ও গানের মাধ্যমে প্রতিবাদ করে কাটিয়েছি। আমার ও আমার পরিবারের সদস্যদের নামে একাধিক মামলা দেওয়া হয়েছে। তাতেও দমে যাইনি।’

জুলাই বিপ্লব সফল হলে ভারতের নদী আগ্রাসনের শিকার হয় ফেনী নোয়াখালীর মানুষ। আলতাফ এই ঘটনার প্রতিবাদ জানান ‘দালালের বন্যা’ নামের একটি গানে। গানটি রাতারাতি ছড়িয়ে যায় সামাজিক মাধ্যমে। কয়েক কোটি দর্শক দেখে গানটি।

রক্তে আগুন জ্বালায় সেজানের ‘কথা ক’

র‌্যাপার সেজানের ‘কথা ক’ শিরোনামের হিপহপ গানটি মুক্তি পায় ১৬ জুলাই। মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে দাবানলের মতো ছড়িয়ে যায়। গানের কথাগুলো মিছিলের মতো প্রতিবাদী। ‘জোর যার মুল্লুক তার/ আগে ক মুল্লুক কার/ লাঠির জোরে কলম ভাঙে শান্তির নামে তুলল খার কাইল মারলি, পরশু মারলি/মারতে আইলি আজ আবার! রাজায় যহন প্রজার জান লয় জিগা তাইলে রাজা কার?’ এমন কথা হয়ে ওঠে কোটি জনতার কথা।

গানটি নিয়ে র‌্যাপার সেজান বলেন, ‘১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে ছাত্রদের মারা হচ্ছিল। সেই রাতে আমি ঘুমাতে পারিনি। পরিস্থিতি ক্রমেই খারাপ হয়ে উঠেছিল। খবরটা শুনে খুব খারাপ লেগেছিল, সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। পরদিন চিন্তা করলাম, কিছু একটা করতে হবে। আমি গানটা পারি। ১৬ জুলাই দুপুরের মধ্যে লিখে ফেললাম ‘কথা ক’। ঘোরের মধ্যে রেকর্ড শেষ করলাম; সেদিন সন্ধ্যা নাগাদ গানটা প্রকাশ করি।

তিনি বলেন, ‘গানটা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। যারা আমার গান আগে কখনোই শোনেনি, তাদের কাছেও গানটা পৌঁছেছে। এর কারণ হয়তো সাধারণ মানুষ গানটাতে নিজেকে খুঁজে পেয়েছে; গানের কথাগুলোকে প্রাসঙ্গিক মনে করেছে।’

গান প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে বিপদ আসতে থাকে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গানে আমি গণমানুষের কথা বলছি, আমাদের ট্যাক্সের টাকায় গুলি আমাদের ওপর চালাবে কেন? তারাও ছাত্র, ছাত্ররা ছাত্রদের ওপর কেন আক্রমণ করে? এই ব্যাপারগুলো কাউকে না কাউকে বলতে হতোই। আমার মনে হয়েছে, ফলে আমিই বলেছি। ওই সময় দেশের অবস্থা খারাপ ছিল। ছোট ভাইবোনেরা মার খাচ্ছে। ওই সময় চিন্তা করেছিলাম, মানুষ হয়তো গানটা শোনার মানসিকতায় নেই। কিন্তু এ গান এত মানুষ শুনেছে, যা অবাক হওয়ার মতো।’

গান ও আন্দোলনের কারণে এলাকাছাড়া হওয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে সেজান বলেন, ‘১৬ জুলাই গান প্রকাশের পরদিন ১৭ জুলাই নারায়ণগঞ্জের চাষাঢ়ায় আন্দোলনেও যোগ দিয়েছিলাম। আন্দোলনে যাওয়ার পরপরই ছবিগুলো ছড়িয়ে যায়। এগুলো নিয়ে অনেক চাপ আসতে থাকে। পুলিশ ও ডিবি খোঁজা শুরু করে। একটা পর্যায়ে এলাকাছাড়া হতে হয়েছিল।’

দীর্ঘদিন ধরে র‌্যাপ গান করেন সেজান। গান আপলোড করেন নিজের ইউটিউব চ্যানেলে। তার চ্যানেলে সাবস্ক্রাইবারের সংখ্যা প্রায় তিন লাখ।

গানের কারণে গুম জেল রিমান্ড

‘আওয়াজ উডা বাংলাদেশ’ শিরোনামে একটি হিপহপ র‌্যাপ গান করেন হান্নান। গানটি ইউটিউবে মুক্তি দেন ১৮ জুলাই। ‘গদিত বইসে স্বৈরাচার কত কিছু সইয়া আর/ তর পজিশন টিক্কা থাকব কত ভাই ক মইরা আর?’ এমন কথা গানটিকে দ্রুত ছড়িয়ে দেয় সারা দেশে। আন্দোলনের ভিডিওর সঙ্গে গানটা জুড়ে দিয়ে অনেকে ভিডিও আপলোড করেন সামাজিক মাধ্যমে।

গানে কথা, সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন র‍্যাপার হান্নান হোসাইন শিমুল এবং মিক্স ও মাস্টারিং করেছে স্নেয়ারবিট।

হান্নান জানান, গানটি সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে ২৫ জুলাই নারায়ণগঞ্জের ভুইঘর এলাকা থেকে তাকে আটক করে ফতুল্লা থানা পুলিশ। যদিও গণমাধ্যমে সে কথা স্বীকার করেননি ওই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। পরে তার জন্য রিমান্ডের আবেদন করলে বিষয়টি জানাজানি হয়ে যায়। ১৩ দিন জেল খেটে যখন মুক্তি পান, তত দিনে স্বৈরাচার পালিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘আমি যখন আটক হয়েছি, তখন থেকে ৩৬ ঘণ্টা আমার পরিবার জানতে পারেনি যে, আমি আটক।’

সে সময়কার ঘটনা মনে করে হান্নান বলেন, ‘কী হচ্ছে, কোনো মামলা দিচ্ছে কি না, কেমনে কোথায় নেবে, বুঝতে পারছিলাম না। দেড় দিন পর যখন কারাগারে দিয়ে আসে, তখন বুঝতে পারলাম, এখানে কিছুদিন থাকতে হবে। দিনগুলো খুব কষ্টকর হবে।’

বন্দি অবস্থার দিনগুলোর কথা স্মরণ করে হান্নান বলেন, ‘আমাকে একটু বেশি অত্যাচার করা হয়েছে। কারাগারের সাধারণ কয়েদিদের মতো আমাকে রাখা হয়নি। আমাকে একটা টাওয়ারে রাখা হয়েছিল, যেখান থেকে বের হওয়ার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। সাধারণ বন্দিরা তো ৭টা থেকে ৫টা পর্যন্ত ঘুরে বেড়াতে পারত। আমাকে ছোট একটা সেলে রাখা হয়েছিল। আমার সঙ্গে আরও দুজন ছিলেন। আমি বের হতে পারতাম না, শুধু তিন বেলা খেতে পারতাম।’

নতুন বাংলাদেশ পেয়ে প্রচণ্ড খুশি হান্নান। নিজের নতুন গান নিয়ে আপাতত ব্যস্ত সময় পার করছেন। সম্প্রতি স্পিরিট অব জুলাইয়ের আয়োজনে ‘ইকোস অব রেভোলিউশন কনসার্ট’-এ গান গেয়েছেন হান্নান। গান দিয়ে তার প্রতিবাদ ও স্বপ্নের কথা বলতে চান এ শিল্পী।

দেশের পরিস্থিতি ফুটে ওঠে পারশার এক গানে

নিজের লেখা, সুর করা ও গাওয়া ‘চলো ভুলে যাই’ শিরোনামে একটি গান ২৮ জুলাই সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করেন পারশা মাহজাবীন। ‘চলো দেখে নিই বাতাবিলেবু লটকনে দেশ ছাড়িয়ে চলো কেঁদে ফেলি ফ্লাইওভার আর মেট্রোরেলটা জড়িয়ে’ এমন জ্বালাময়ী কথা ফুটে ওঠে পারশা মাহজাবীনের গানে। এই গানটিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক মাধ্যমে।

গানটি নিয়ে পারশা বলেন, ‘মাত্র ১০ মিনিটে বসে গানটি লিখে ফেলি। তখন মাথায় আর কিছু ছিল না। কেবল গানের কথাগুলো ঘুরছিল। গানটা দেশের মানুষ যেমন ভালোবেসে গ্রহণ করেন, তেমনি কমেন্টে হুমকি দিতে থাকেন অনেকে। ভাগ্য ভালো আমার নাম্বার খুব বেশি মানুষের কাছে ছিল না। আমার ঠিকানাও জানত না। ফলে অনলাইন ছাড়া খুব বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘আমি চাই আমার দেশ মা, আমার বাংলা মা আবার সুস্থ হয়ে ফিরুক। যে দেশের মাটিতে বসে আমি শব্দচয়ন শিখেছি, গাইতে শিখেছি, এভাবে লিখতে শিখেছি সেই দেশ ভালো থাকুক। আমি চাই, আমার দেশের মানুষ ভালো থাকুক, আর কোনো মায়ের কোল খালি না হোক। আমি চাই সব সহিংসতার বিচার হোক, আমার ভাইবোনদের রক্তের দাম দেওয়া হোক। সেই ভাবনাই গানে ফুটিয়ে তুলেছি।’

নতুন গান লেখার পাশাপাশি পারশা ব্যস্ত অভিনয়ে। সম্প্রতি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম চরকির একটি ওয়েব ফিল্মে অভিনয়ের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছেন। জাহিদ প্রিতম পরিচালিত ওয়েব ফিল্মটির নাম ‘ঘুমপরী’। ঘুমপরী দিয়ে প্রথমবারের মতো কোনো ওয়েব ফিল্মে অভিনয় করছেন এই গায়িকা ও অভিনেত্রী। ফলে কাজটা নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত পারশা মাহজাবীন।